অবগাহনের শেষ বিন্দুটুকু মেলে দিলাম সারস চঞ্চুতে,
পশ্চিমে চেয়ে আছি, একটি ফ্যাকাশে লাল টীকা ঘুমোতে যাচ্ছে নরমে,
তার চেয়েও নরম তোমার চোখের চাওয়া,
বারবার দুহাতে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেওয়া মুখ,
আলো আঁধারে গ্রীবায় অতি সংকোচে, যেন নব সন্ন্যাসীর ভিক্ষা চাওয়ার মত,
একটি দুটি চুমু, দাগবিহীন প্রেমে খোদিত হয়ে যায় মাধুর্যে....
ভালোবেসো না আমাকে,
এই যে বসন্তের উদাস পাগল হাওয়া,
সারাটাদিন বারান্দার গাছের মৃতদেহগুলি আর তেলগন্ধী গামছার সাথে,
নোঙরছেঁড়া ডিঙির মত ওলোটপালট করছে আমায়,
তোমাকে টপকে দেখতে চাইছি, পারছি কই!
তাই অন্ধ করে চোখ মুছিয়ে নিচ্ছি পদ্মপাতার দীর্ঘশ্বাস,
যেখানে তুমি কলি ফোটানোর মত লজ্জ্বা ফুটিয়ে তুলেছো সৌগন্ধে,
এই সুবিশাল কাদাজলে এই সামান্য অনুরাগটুকু স্মৃতি হয়ে থাক,
অনন্ত নয়, মুহুর্ত হোক জীবন পাথেয়।।-
হাত ডোবালেই নরম পাথর গলিয়ে পড়ে আঙুল ফাঁকে,
বৈঠা ছাড়াই মানুষ আসে, মানুষ যায়,
তাদের বুকের নিঃশ্বাসে ছায়া পড়ে যায় জলে,
এই বিশাল দেহ, যারা উষ্ণতা খুঁজে ছুঁয়েছিল বা,
পায়ের কাদা ধুয়ে নিয়েছিল ঢেউয়ে,
তাদের আমি ভালোবাসি না আর,
নৌকোর শ্যাওলাধরা তক্তা ফাঁকে পলি বালি বিছিয়ে দিই,
ঠোঁটের আঁচড়ে শঙ্খচিলের ডানা সাদাটে থেকে ধূসর হয়ে আসে,
হতে তো পারতাম বলো অঞ্জলি ভরা তৃষ্ণার জল,
তুমি তো দাহ নেভাতেই এসেছিলে,
তোমার চিতার কাঠ, দেবীর কাঠামো, রক্তমাখা বস্ত্রের স্তূপ,
সব ধোয়াতে গিয়ে আমার আর অশ্রু সাজা হল না.....
বৈঠা ছাড়াই মানুষ আসে, মানুষ যায়, সারি সারি মানুষ,
ধুয়ে নেয় পায়ের কাদা, শরীরের রস, প্রেমের রক্ত....।।-
উষ্ণতার অবসরে
আমার প্রতি
এতটা হয়ো না মায়াবতী,
পথের পাশে ছড়ানো থাকে নুড়িবালির মতো তোমার যত্নগুলো,
কুড়োতে চাই, কুড়োতে যাই না,
প্রেমের কাছে নত হতে হতে নীল তিমির ছড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছি শিরদাঁড়া,
ঝোঁকা বারণ ভালোবাসার তরে....
তোমার জীবনদহনের যৌন দীর্ঘশ্বাসে
সাদা রক্তের ব্যথার মত লেগে আছি আমি,
উপত্যকায় অনেক জল,
তলায় আগুন,
তোমার বুকের রোমকূপে পরত পড়ছে স্নেহের,
লক্ষ্মীপুজোর কদমা ভাঙার মত মায়ার টুকরো ভেঙে দিও না আমার হাতে,
আমি কষ্টকে বড় ভয় পাই,
তাই কষ্ট দিতে চাই না....
চোখ বুজলেই কেন ময়দান ভেসে ওঠে?
কেন একটা নোংরা ঘেয়ো লোক বালতি করে রক্ত ঢেলে দেয় ঘাসে?
আমার ভিতরে গ্লেসিয়ারখানা প্লুটোর চেয়েও শীতল,
তুমি উষ্ণতা চেয়ে বোসো না প্লিজ!
বরং উষ্ণ দিনের অবসরে আমার হাতের পাতায় মেখে নিও হিম।।-
প্রিয়জন
তোমার কাছে আসলেই কেন ভেতরে এত এলোমেলো হয়ে যাই বলো তো?
অথচ সারাটাদিন ঠিক থাকি,
ঠিকঠাক রেটিনার নোনাজল মেখে ভাত খেয়ে নিই,
অযোগ্য অক্ষমতার গল্পগুলো কানের পাশে বিনবিন করে ভ্রমরের মতো,
আর আমি ইন্টারনেটে ঘাঁটি কোন ফুলে কত সৌগন্ধ....
ক্লিভেজের ভিজে দাগ বা উরুসন্ধির ক্লিপিংস বিলোই,
আত্মাছাড়া শরীরগুলো বিস্কুটদৌড়ের মত নৃত্য করে,
সব ঠিক থাকে....
তবু প্রতিটা রাতে তুমি আসলেই আমার ভীষণ মৃত্যুচিন্তা পায়.....
কিভাবে কবে জানি না,
তুমি কথা বলে যাও, সাধারণ স্বভাবের গল্প,
পুকুর রেলগাড়ি বা হাটুরে লোকের বেনাজমির কথা,
আমি শুনি, আমি বলি,
আর মাথার ভেতরে মৃত্যুর পোকারা থিকথিক করে,
তুমি ডাকলেই কেন এত মরতে ইচ্ছে করে বলো তো!
আসলে আমার গোপনে রাখা ব্যথার যতনঘরে,
দরজায় দাঁড়িয়ে থাকো তুমি......
আকন্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করে আছি,
কখন আমার দুয়ারে ফেলবে তোমার ঘন ছায়া....
তোমার শীতল হাওয়া জুড়াবে আমার মন.....
তোমার পায়ের সামনে বসবো, মাথা তুলে চাইবো তোমার চোখে!
তোমার আঙুল আমার মুখে বুলিয়ে দেবে শান্তি অনুক্ষণ.....
তুমি মৃত্যু, আমার বড় সাধের বড় প্রিয়জন....।।-
দাবদাহ
আমি হয়তো জ্বলছি,
আমি জানি না কেন হঠাৎই পথে বারুদ পোড়ানো শুরু হল,
আমার পেটের ভেতর নাছোড়বান্দা কীটের মত ব্যথা,
অতি উৎসাহে ঘুরে মরছে,
তুমি বিকেলের ট্রেন ধরে এলে,
বাতার চুপড়িতে ভরতি ভরতি ফল, ভ্যাপসা গরম,
ফলের রঙ লাল অথবা তুমি নিজেই বলবে,
আমরা আবার আদমিভ হতে পারি না?
আমি আঙুলে তোমায় তুলছি বিছানায়,
তুমি নামছ কোন্নগরের গঙ্গার মত গভীর নীচে,
চোখে কোষে অস্বস্তিকর দাবদাহ.....
শুধু তোমাকে দেখাতে এনেছিলাম,
নপুংসক কাকে বলে.....।।
-
রাতের বয়স বারোটা বারো। ধর্ষিতা কিশোরীর মাথার মত উদভ্রান্ত হাওয়া দাঁত নখ বার করে ক্ষতবিক্ষত করে চলেছে সবুজ পর্দার নীল তাঁবু। বিষের মত অজস্র অদৃশ্য সূচ বৃষ্টির কাছ থেকে অভিশাপ ধরে এনে শীতলতা বিঁধিয়ে দিচ্ছে আমার প্রতিটা রোমকূপে, যে রোঁয়াগুলো আমি পরাপৃথিবীর কোনো প্রেমিককে উৎসর্গ করব বলে ফুল ভলিউমে কানের ভেতর ভ্রমরের মত ঢুকিয়ে রেখেছি "না হোকে ভি করীব তু হমেশা পাস থা..."। একটু আগে প্রাক্তনের সাথে কথা হচ্ছিল স্বাভাবিক বন্ধুত্বে। এখন দুটো চোখে লুব্রিক্যান্টের মত লেগে থাকা পরাবেশে আমি মাপছি এই হাওয়াটার থেকেও বেশি শীতল হতে পেরেছি কিনা। পাশের ঘর থেকে মাঝেমাঝে হাঁফ ওঠে। ঘেয়ো কুকুরের পশ্চাদ্দেশে লাথি মেরে মেরেও তাড়ানো যায় না বলে আমি এখন পেপার নাইফ দিয়ে কেটে ছড়িয়ে দিই মাংসের দলাগুলো, যদিও এভাবে রক্তের দাসখত মেটানো যায় না...। কদিন আগে একটা পাঁজরভাঙা কঙ্কাল তুলে এনেছিলাম কন্ডোমের ভেতর থেকে। হড়হড় করে আমার গায়ে দুর্গন্ধওয়ালা বমি করত যখন, তখন ভেবেছি "শুদ্ধ হোক"। এখন আমায় উপুড় করে মাটিতে ফেলে স্যাবোটেজ করতে চাইছে। সেই গন্ধটা এখন বমি তুলছে আমার। আমাদের বরানগরের আকাশটা কক্ষণো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার হয় না। বুড়ি বেশ্যার মত ধ্যাড়ধ্যাড়ে হলদে আলোর নীচে চামড়ার নীচটা নগ্ন করতেও কেমন লাগে। লাল বালিশ কাঁদার জন্য ডাকে। আমি কাঁদি না। শুধু কাঁদতে পারলাম না বলে বাজারে রেন্ডী হয়ে গেলাম ওভি মুফতে।।
-
হলুদ খামে
আমার যাবতীয় অসুখবাসনা আমলাশোলের ক্ষুধার্ত জনতার মত হাঁ করে থাকে,
তোমার শিঞ্জিনীর মত আঙুল ভুরুর উপর মোম গলে পড়বে বলে,
বুকের অগোছালো আবদারের রহস্যে যে কটা শেষ দীর্ঘশ্বাস তুমি ফেলে গেছিলে,
ওদের ভাবছি উড়িয়ে দেব, রেলের তারের ফিঙেপাখির লেজের মত,
জানো আজকাল ভীষণ বুঝি আমি, মানুষ রাস্তা বেড়াল পাঁচিল পুটুসফুলের ঝোপ,
এতটা নিঃশব্দ কাঁচের রঙের প্রশান্তি মাথার ভেতর এলো কোথা জানি না,
সারি সারি লাল কাপড়ের টুকরো যায়, ডাণ্ডায় বাঁধা, বাতাসে রক্তের ঘ্রাণ,
ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলা পরাজিত জনতার ব্যর্থ খয়েরি শোক,
কিচ্ছু আমাকে তোমার করুণার মত স্পর্শ করতে পারে না, এতটুকুও না,
আমি কি তোমার অপেক্ষানুসারে বসন্তের চিঠি পাঠাব? মনখারাপের হলুদ খামে?
নাঃ! থাক সেটা, অপেক্ষা ফুরোলেই বৃষ্টি নামে, বসন্তে বর্ষা অসুখবাসনা।।-
ভিজেছে মন
এভাবে আটকে দিও না,
যতদূর তোমার কপালে চুমু খেয়ে ফিরে আসা যায়,
ততদূরেই শুধু ভালোবাসতে দিও না আমায়,
কার্নিসে বসা কাকটার মত অবিরত,
গড়ানো শালুকছাপ বিষাদী বৃষ্টি,
কে বেশি কেঁদেছিল জানা নেই,
জানা নেই আমাদের সম্পর্কের নাম,
শুধু এভাবে স্পর্শ দিও না....
তপ্ত কপালে হাত রাখবার আগেই,
তোমার শাড়ির মাড়ের গন্ধ এসে লাগে,
টিনের ফুটোর নীচে তোবড়ানো হাঁড়ি বসিয়ে রেখেছি,
ওটার মত আমাকে ভালোবেসে উপচে দিও না,
আমার শরীর ভরে কাণায় কাণায় ঝরে পড়ো না পাগলধারায়,
নতুন বোনা কাঁচা ধানের মত রোমকূপে,
বসন্তের গহন ঝড়ের দু এক ফোঁটার মত,
ব্লাউজে জমা বৃষ্টির দু এক মুঠোর মত,
ভিজিয়ে দিও না দেহ,
ভিজেছে মন, শরীর ভিজলে কোথায় যাব বলো?-
কথায় কথায়
মাংসের চাক চাক নম্রতা কালচে গোলাপীর ঘ্রাণে দেওয়াল ছুঁয়ে ফিরে আসে,
যে স্পটটায় কাঁধের ভঙ্গুর দাগ চাপা পড়েছিল দুহাতের দানব তালুতে,
নবজাতকের ভাগ্য ফুটছে, টগবগ করে ফ্যানের মতো,
গড়াচ্ছে জনক জননীর হ্যালহ্যাল করা লোভের থুতু, সন্তানের ভবিষ্যতে;
রিক্ত দুহাতে অজস্র ব্লেডের চুমু প্রেমিকের অশ্রু হয়ে নেমেছিল শহরে,
ভালোবাসলে মানুষ নর্দমার গন্ধটুকুও পায় না, বা পেলেও ভালোবেসে নেয়,
আর বাকি ফ্রয়েডের ফ্রাস্টেটেড গিনিপিগরা, লম্বাটে ধোঁয়া ধোঁয়া,
কম্পিটিটিভে যতবার হারে ততবার বলে, মুখে নিবি কিনা বল!
একটা আধখানা লোক একা স্টেজ বেঁধে স্লোগানের কথা ভাবে,
উঁচুতে তোলা স্থির বা স্বমৈথুনে গতিশীল মুঠো, তফাত খুব বেশি নেই,
মানুষকে সবচেয়ে বেশি চালানো যায় ফাঁপা শব্দে, মাইকের আয়োজনে,
অথচ কথায় কথায় দেওয়া খিস্তিগুলো সত্যি হলে দুনিয়াটা এত একলা হত না।।-
কত ক্ষোভ জমে
নিষ্পৃহতায় আটকানো যে পাখির পা,
তার জন্ম না সাধে ফাঁদে না সাধে খড়কুটোয়,
ভাঙা আকাশের আয়নাগুলি রোজ পর্যাপ্ত বদ তকমা রেখে যায় আঁখিতে,
পালকের বাসা ছিঁড়ে পাখি উড়তে শিখেছিল, কিন্তু ওড়ে নি অব্যক্ত বদান্যতায়....
রাতের পেঁয়াজকলি রুটিসবজির আলেখ্য বাস্তবতা উদযাপিত হলে,
তুমি কর্কের ঢাকনা খোলো, গ্লাসের ভিতর ক্লিওপেট্রার ভূমধ্যসাগর,
আমি চোয়ালের নীচে হাতের পাতা রেখে তোমার মৃত্যু দেখি প্রতিদিন,
একটু একটু করে তোমার রক্তহীন মাংস বেচার ছল,
আমি চাইলে আটকাতে পারতাম,
আটকাই নি, তোমার দাসত্ব মনোবৃত্তিকে সম্মান করে,
যেভাবে আমার প্রেম আজীবন পেয়েছে প্রত্যাখ্যাত সম্মান....
পাখিরা আসলে পাথুরে নদী ভালোবাসে,
শ্যাওলাবিহীন শেকড়বিহীন পরিচ্ছন্ন নুড়িপাথর,
আর তুমি ভালোবাসো মানসিক বন্দীশালায় আটকে থেকে,
জাগতিক বন্দীশালায় কোতল হতে যাওয়া,
কত ক্ষোভ জমে জমে বুকের ভেতর ভিসুভিয়াস তৈরি হলে,
ম্যাসোচিজমে মুক্তি খোঁজে মানুষ,
তোমার তো তাও ক্ষোভটা আছে,
আমার আছে তোমার ব্যথার নীরব দর্শনপ্রিয়তা।।
-