.....সহযাত্রী.....
মহাসপ্তমীর রাত, আমি সারাদিন কোলকাতার দূর্গোৎসব দেখে বেশ রাতের একটি ট্রেনে বাড়ি ফিরছি.... সারাদিনের হাটাহাটির পর পা দুটো হালকা অভিযোগ জানাতে শুরু করেছে.... আজ রোদগরমও ছিল খুব....
স্বাভাবিক ভাবেই কামরাটি ফাকাই ছিলো... আমার সামনে একজন এসে বসলো, বয়স ওই আটত্রিশ-চল্লিশ হবে.... জামাকাপড় বেশ মলিন, ছেঁড়া চটি,, মেরুন রঙের জামায় শুকনো ঘামের সাদা ছোপছোপ দাগ.... বোঝাই যায়, আমি যখন প্যান্ডেল হপিং করতে মশগুল ছিলাম, তখন আমার সহযাত্রীটি কোনো বাবুর জোগাড়ি খাটছিলো পেটের টানে... পকেট থেকে সারাদিনের কামাই দেড়শোটা টাকা গুনে নিলো বার কয়েক.....
এমন সময় এক বাদামওয়ালা বাদাম ফেরী করতে ওঠে কামরায়... লোকটি পকেট থেকে দশটাকার একটা নোট বের করে কিছুক্ষণ কি যেন ভাবলো, বাদামওয়ালার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে দশটাকাটা আবার পকেটে পুরে নিলো....
চলন্ত ট্রেনের ফুরফুরে হাওয়ায় লোকটির উসকো চুলগুলো উড়ছে, চোখদুটোয় উদাসীন তৃপ্তি স্পষ্ট.... আজ আমার ঠাকুর দেখা সম্পন্ন হলো.....-
লন্ডনের আশেপাশেই থাকি
মা ভালো রান্না করে
তাই বাড়িতেই খাই
মোষদের পছন্দ নয়
তাই ... read more
.....জেদি.....
"ধূপ নেবেন ধূপ? ভালো গন্ধওয়ালা ধূপ আছে,, ধূপ নেবেন??"
মহামারীর বাজারে সবাই যখন বাড়িতে বসে ওয়ার্ক ফ্রম হোমের নামে ছুটি কাটাচ্ছে, আমার অফিস যেমন কে তেমন খোলাই আছে, কে জানে হয়তো পৃথিবী ধ্বংসের আগের দিনও বলবে আজ অফিস আসতে হবে... খানিকটা বিরক্ত মনেই অফিসের বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম।
এমনসময় দেখি বছর পঁয়ত্রিশের এক যুবক, এক হাতে একটা লাঠি আর অন্য হাতে কিছু ধূপের প্যাকেট নিয়ে ফেরি করতে করতে যাচ্ছে। বাংলায় এর মধ্যে বর্ষা এসে গেছে, তাই মাথায় একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট বাঁধা। কিছুটা কৌতুহলের বশেই এগিয়ে গেলাম....
-"ও ভাই,, ধূপ কত করে?"
-"দশটাকা প্যাকেট দাদা, ভালো ধূপ, নিন না...."
নাম অবিনাশ, চোখদুটোর প্রায় আশি ভাগই নষ্ট হয়ে গেছে, এমনিতে ট্রেনে ফেরি করতো, কিন্তু লকডাউনের চক্করে সে রাস্তাও বন্ধ। কিন্তু পেট কি বশ মানবে? তাই হার না মানা একটা জেদ বেরিয়ে পড়েছে বৃষ্টির তোয়াক্কা না করে।
নিলাম এক প্যাকেট ধূপ, ফিরে গেলাম কাজে,,, দশ টাকার ঘুষ দিয়ে কিনলাম একটা জেদ, লড়াইটা চালিয়ে যাওয়ার.....-
...সিংহনাদ...
মফঃস্বল এলাকায় চাকরীটা পেয়ে এক মেসবাড়ী ভাড়ায় উঠলো সোমক। দুটি ঘর,, একটি বেশ বড়, তাতে সাতজন থাকে,, আরেকটি ছোটঘর, সেখানে মাঝবয়েসী মেঘনাদবাবু একা ঘুমোন। আপাত নিরীহ মেঘনাদদা ঐ ঘরটিতে একা রাজার মতো কেন থাকে জানতে চাইলে, সকলের মুখেই মুচকি হাসি। দিগ্বিদিক না বুঝে সোমক বড় ঘরটিতেই আশ্রয় নেয়।
কিন্তু, রাত ঘনাতেই শুরু হয় নাসাগর্জন প্রতিযোগিতা। সপ্তরথীর সপ্তসুরে হাঁকডাক, যেন মোৎসার্ট ভর করেছে। ঘুমের দফারফা,,,, নাহ! কাল আর এই ঘরে শোওয়া যাবেনা।
পরিকল্পনা মাফিক পরেরদিন মেঘনাদদার ঘরেই শোয় সোমক,, মেঘনাদদাও পরমস্নেহে তাকে নিজ ঘরে স্থান দেয়...
কিন্তু মাঝরাতে হঠাৎ,,,,,, 'গুদুম্'!...... 'গড়াম্'!!
এ..... একি!! লোকটা নাক ডাকছে?? নাকি আমেরিকা ইরাকে বোমাবর্ষণ করছে??! হতভম্ব সোমক এক কোণে ঘুপটি মেরে বসে থাকে,, যেন এক আতঙ্কিত আতঙ্কবাদী গোলাবর্ষণ থামার অপেক্ষায়.....-
সারাদিনের দৌড়ঝাঁপ,
শত ব্যাস্ততার পরেও
একটা মাঝরাত ছিল
খুনসুটি, আড্ডা,
অন্যায় দাবীতে ভরা
একটা মাঝরাত
সকল যন্ত্রণা ভোলানো
একটা মাঝরাত
-
সিঁদুর... খেলা?!
বিজয়া দশমীর সকাল, সিঁদুর খেলা চলছে,,, মণ্ডপের দুপ্রান্তে দুজনার আবার দেখা, বেশ কয়েকমাস পর। মনে পড়ে এরকমই এক দশমীর সকালে দুজনার পরস্পরকে দেওয়া কথাগুলো... সারাজীবন পাশে থাকার কথা, তারপর অগ্নিসাক্ষী করে দুটি প্রাণের একাকার হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু নিয়তি যে বড্ড ক্রর,, মনোমালিন্য, অশান্তি সম্পর্কটাকে টেনে নিয়ে যায় আদালতের দোরগোড়ায়, সামান্য কাগজ কলমের আঁচড় মিথ্যে করে দেয় সাতপাঁকের প্রতিজ্ঞাগুলোকে।
শিবমই এগিয়ে যায় আগে - "কেমন আছো?"
"ভালো,, তুমি কেমন আছো?" - একটু ইতস্তত ঈশানী।
"সত্যিই কি ভালো?" - শিবমের চোখে প্রশ্ন।
ঈশানীর মুখে কোনো জবাব নেই,,, কিন্তু চোখ বলে যাচ্ছে হাজারটা কথা...
"তোমায় আজ খুব সুন্দর লাগছে... কিন্তু একটা কিছু যেন বাদ থেকে গেছে" - বলে চলে শিবম।
"তুমিই তাহলে সম্পূর্ণ করে দাও" - ঈশানীর চোখেমুখে এক অনুরোধের দাবী।
দুজনার ধূসর জীবনে ফিরে আসে লালের ছোঁয়া... মণ্ডপে মাটির উমার চোখে যেন একটু ঝিলিক দিয়ে ওঠে,, বাড়ি ফেরার পালা...-
...সেতু...
কালীকাপুর আর মোল্লাপাড়া, সোনার বাংলার দুটি অতিসাধারণ নিম্নবিত্ত গ্রাম। একটি হিন্দু তো আরেকটি মুসলিম প্রধান কসবা। মধ্যিখান দিয়ে বয়ে গেছে হরকী নদী। দুই গাঁয়ের একমাত্র যোগসূত্র ছিল একটি কাঠের সেতু, যেটি গতবর্ষায় হরকীর জলে ধুয়ে গেছে।
স্বভাবতই ঈদের পবিত্র মরশুমে দুই গ্রামের মাঝে যেন এক অদৃশ্য পাঁচিল উঠে যায়। প্রশাসনকে শত অনুরোধ করা সত্বেও, সরকার বাহাদুরের গয়ংগচ্ছ মনোভাবে সেতু ফাইলবদ্ধ ধূলোয় ঢাকা পড়ে যায়।
নাহ্, এভাবে তো আর বেশীদিন চলতে পারে না, পূজো তো প্রায় চলেই এলো। গ্রামদ্বয়ের সাধারণ মানুষজন চাঁদা তুলে দিনরাতের কঠোর পরিশ্রমে আবার একটা নতুন সেতু গড়ে তোলে।
দূরে ঢাকের শব্দ শোনা যায়, উমা এসেছে ঘরে, হরকীর দুই পাড়ে কাশের জঙ্গলে হাওয়ার দোল লেগেছে...-
..জলাঞ্জলি..
"কিরে ভাই,, এই বৃষ্টি বাদলার দিনে এতো ব্যাগ প্যাঁটরা নিয়ে কোত্থেকে আসছিস?" - জলকাদা ডিঙিয়ে বস্তা বোঝাই উৎসবকে হেঁটে আসতে দেখে প্রশ্ন করে সম্বিৎ।
চওড়া হাসি মুখে উৎসবের জবাব - "আরে ভাই,, পূজোর কেনাকাটা করতে হবে না?! অষ্টমী স্পেশাল পাঞ্জাবী, দুটো জিন্স, একটা শার্ট, একটা টিশার্ট আর একজোড়া স্নিকার্স নিলাম.. তোর পূজোর বাজার কমপ্লিট?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ কবেই,, এবার পূজোয় তিনটে আলাদা আলাদা রঙের রেইনকোট নিয়েছি, সাথে একজোড়া গামবুট,, আর ভাসানের জন্য বিশেষ ওয়াটারপ্রুফ রেনবো টুপি নিয়েছি একটা" - নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে চলে সম্বিৎ।
অট্টহাসে ফেটে পড়ে উৎসব - "তুই কোনোদিনই রসিকতার কোনো চান্স মিস করবি না বল? সবেতেই তোর ঠাট্টা.."
সময় এগিয়ে যায় নিজ বেগে,, দেখতে দেখতে পূজোও চলে আসে..
"কিরে ভাই!? অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি দিবি না? আয় শিগগির.." - ফোনের এপারে উৎসবকে তাড়া লাগায় সম্বিৎ।
বিরক্তি উথলে পড়ছে উৎসবের গলায় - "ধুর ছাই,, এই হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটা পুরো পূজোটাই কাদা করে দিলো.. সত্যি করে বল তো ভাই,, তুই কি সত্যিই রেইনকোট কিনেছিলি?"-
মনখারাপের বৃষ্টিটা,
আর আগুন জ্বালায় না মনে..
দুটো শরীরের ভালোবাসা মাখা
ময়লা চাদরটা বদলে গেছে কবেই..
নোনতা ঘামের গন্ধ,
রক্ত গরম করা শরীরি নির্যাস,
ঠাঁই পেয়েছে আস্তাকুঁড়ে..
তবু মুখপোড়া বৃষ্টিটা
কেঁদে মরে খালি..
দোহাই দেয়, চিৎকার করে..
"শুধু একবার ফিরে আয়.."-
..মানুষ!! সত্য??..
”উফফ, মা কখন আসবে? ক্ষিদে পেয়েছে খুব..” - কুঁইকুঁই করে ওঠে ছোট্ট ছানাটা..... ”চুপ কর তো,, তুই বড্ড ছটফট করিস,, মা খাবার খেতে গেছে,, ফিরে এসেই আমাদের দুধ খাওয়াবে” - ধমক দেয় বড়জন। চারটি কুকুরছানা,, এই ক'দিন হলো চোখ ফুটেছে,, পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে ক্ষিদের জ্বালায়....
’ওই মানুষগুলো ডাকছে,, নিশ্চয়ই কিছু খেতে দেবে’ - লেজ নাড়তে নাড়তে তাদের দিকে এগিয়ে যায় লালি। এই লালি নামটা তাকে কিছু মানুষ বন্ধুই দিয়েছিলো। এই মানুষগুলোও খুব ভালো,, মহোল্লাসে তাদের দেওয়া পাউরুটিগুলো সাবাড় করতে থাকে সে। এসবের মধ্যে খেয়ালই করেনি, এই সুযোগে ওদেরই একজন কখন একটা দড়ি তার গলা দিয়ে জড়িয়ে একটা ট্রাকের পিছনে বেঁধে দিয়েছে....
বেশ কিছুটা ট্রাকটার সাথে ছুটেছিলো লালি,, তার যে ছোট্টছোট্ট চারটে দুধের বাচ্চা আছে,, কিন্তু আর পারেনি.. মাংস আর রক্তের মণ্ড ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে রাস্তায়.... গুটিকয়েক কুকুর সেই হাড়-মাংসই চিবোতে থাকে,, তাদেরও যে পেট ভরিয়ে ফিরে যেতে হবে,, বাচ্চারা অপেক্ষা করছে....-