সময় শেষ হয়ে এসেছে। চলে যাও আজ এই ক্ষণে। মেঘেদের ঘনঘটা বয়ে চলে গেছে শহরের দেহ জুড়ে। আবেগ সাগরে ভেসে ভেসে যে ঝিনুকের দেহ বয়ে চলে তাকে নিয়ে নিও শাড়ির খুঁটে বেঁধে। যে অগ্নিবিন্দু কপালের টিপ হয়, যে শঙ্খের গলা চিরে পরে আছে বধূ শাঁখা। তাদের ঠিকানা কেউ জানে না এই সাঁঝে। তবু বাতাসের গায়ে পুজোর শব্দ বাজে। জলচৌকির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছো যে ঘরের কোণে। সে ঘরে শুধু স্থিরতা, মৃত্যুর সুবাস। জন্মের আদিতে যে পালক মেলে রেখেছিলে আশ্বিনের কঙ্কালে। সেখানে বুক চিতিয়ে বসে আছে অন্ধ চড়ুইপাখির দল। সমস্ত আসবাবে লেগে আছে তোমার গন্ধের মত হাওয়া। আমাদের সংসারে যে শুকনো মাটি রেখে গেছো তুমি, দীর্ঘকাল ধরে আরও শুকিয়েছে খানিকটা তার দেহ। পাথর প্রায় মাটিতে গড়িয়ে পড়েছে যে পাহাড় কাটা ঝর্ণা জল, সে জলে ভেসে এসেছে ঝিনুকের শিরা। সময় গিয়েছে ক্ষয়ে। তুমি চলে গেলে ' আসি ' বলে। আজ সময় হয়েছে শেষ। আমি ভেসে যাই ঝিনুকের প্রায়, ঝিনুকের ডিঙি বেয়ে।
-
রাতপরীদের গল্প বলা যাক। ঝিনুকের নাভিমূলে যে গভীর খাদ, সে খাদে ডুবে যাক মায়াসাম্রাজ্য, সেনাপতির তলোয়ার। গভীর নীল জল খেয়ে ফুলে ফেঁপে উঠুক তারামাছের বাহুমূল, বিষাদের শঙ্খনাদ। আগমনীর বাতাসে ভ্রাম্যমাণ কাশফুলের অলংকারে ঢেকে থাকুক সমস্ত রকম খামতি, ক্ষতর আয়ুরেখা। এ দেহের বিষুবরেখা বরাবর অবিরাম বয়ে চলে যে চঞ্চল আকাঙ্খা, তার ঠাঁই হোক কোনো সদ্য ফুটে ওঠা পদ্মনাভির কেন্দ্রে। ভেঙে যাক দুঃখ সমস্ত কালো মেঘের উপোস ভাঙার সাথে, বৃষ্টির সাথে, রামধনুর খসে পড়ার সাথে। কোনো মূকাভিনয় সেরে বাড়ি ফেরা শিল্পীর মত কঠিন হয়ে উঠুক সমস্ত হাতকড়া পরা অভিমান, অভিযোগের থোকা। সন্ধ্যার শঙ্খসুরে ঘুম ভেঙে যাক সমস্ত পঙ্গু পানকৌড়ির। উড়ে চলে যাক এক সায়র থেকে অন্য দীঘির দেহকোষ ছুঁয়ে। রাতপরী তবু ঠায় বসে অপেক্ষায়। যে গাছ কখনো হয়নি রোপণ , প্রস্ফুটিত হয়নি যে কাঞ্চন ফুল, তার বিরহে আকুল হয়ে কাঁদে বোবা রাতপরী। শরত আসে, শরত ফিরে যায়। কাশফুল, পদ্ম এবং শিউলির চক্রান্ত ঢেকে রাখে আদিম দুঃখ, প্রাচীন পত্রিকা। আর ঝিনুকের নাভিমূলে যে গভীর খাদ, সেখানে বসে থাকে মায়া সম্রাজ্ঞী; নিঃশব্দে ডুব দেওয়ার অপেক্ষায়।
-
সাগরের ভেতর যে সব ঝিনুকেরা রাত্রির নাভিতে শুয়ে থাকে; যেসব ইঁট ভাটায় মরে যায় প্রজাপতি, বাদুড়ের ডানা, তাদের হারতে দিও না। হারতে দিও না আসমুদ্র জলরাশির মত তোমার চোখের কোণ। ঝর্না কলমের কালি মাখা বইয়ের লাইনে বেঁচে থাকুক অঙ্কুরিত প্রেমের পরাগ। উত্তপ্ত লেলিহান শিখায় জ্বলে পুড়ে যাক আবহবিদের ভবিষ্যতবাণী। বট গাছের ভাঙ্গা ডালের ক্ষত জুড়ে ঘুরে বেড়ায় যে সব শ্যামা পোকার দল, নিরবিচ্ছিন্ন প্রেম ছিঁড়ে খায় যেসব অনন্ত বিরহের শিরদাঁড়া, তাকে ফিরে যেতে দাও অসীম, সামুদ্রিক সুখের কোলে। আয়নার ঢাকা সরিয়ে যে মুখ ফুটে ওঠে, যে ভুরু জোড়ার মাঝে জায়গা হয়ে যায় লাল নীল কালো রঙিন টিপের। সেই খানে ছুঁয়ে যাক সমস্ত শরতের মেঘ, পদ্মনাভির ঘ্রাণ, আরতির কর্পূর, বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ এবং যাবতীয় অযাচিত উপহার। নাগরদোলা তুলে নিয়ে যাক ভাড়াটের বাড়াবাড়ি প্রেম, স্বপ্ন জুড়ে দুঃস্বপ্নের রাতদখল, অন্ধকারে জোনাকির অর্ধমৃত দেহ। দিয়ে যাক এক ঝুড়ি শিউলি, আগমনী বাঁশি, সোনা কাঠি, রূপো কাঠি, নক্ষত্রের মালা। আর দিয়ে যাক নিখোঁজ চিঠির খাম, ঝড়ের শেষে ছেঁড়া পাল,নিষিদ্ধ আধুলি এবং রাত্রির নাভিতে সাগরের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া ঝিনুকের নিথর শীতল দেহাবশেষ।
-
তোমার কথা শেষ হলো যেই স্থানে
আমার মনের খুব গভীরের সই,
যেই নীল জল মুকুট করে পরো
আকাশ ছাড়া সেই নীল তার কই?
কোন রাতে সব জ্যোৎস্নার বাড়াবাড়ি
কোন ঘরে আজ পায়েসের তোড়জোড়,
শিউলি কাশ আর পদ্মের খুব ভিড়ে
ঘুরিয়েছে আজ অপরাজিতা মোড়।
দিনভর জুড়ে সূর্যের মাতামাতি
রাত্রি হলেই চাঁদের বাঁশি বাজে,
জলসাঘরের নাভির ভিতর আজও
নীলচে আলোর ঝাড়বাতি খুব সাজে।
এত নীল রং আগলে রাখছি বলে
বাষ্পের মত উবেই গেছে তারা,
আর কোনো রং রাখবো না খুব কাছে
লাল নীল সব একই, নেই কোনো ফারাক।
-
ফুলদানিতে মারছে উঁকি
মরচে ধরা হলদে গোলাপ,
এই শ্রাবণে চাইছি আমি
মিথ্যে হোক আজ প্রথম আলাপ।
যার ভুলে ফুল ক্ষতর মালিক
সেই মালিও ধুঁকছে জ্বরে,
বাগান জুড়ে গাছের অসুখ
চাইছি মালি ফিরুক ঘরে।
সূর্য ডুবে যাচ্ছে যখন
রাতের আকাশ মেলছে পেখম
মালি - মালিক কেউ জানে না
একই ভুলে দুজন জখম।
দুঃখ আমার থাকত না আর
ফিরত সে ও নিজের বাড়ি,
একটি বারও বলতে যদি
'দুঃখ কিসের? জানতে পারি?'-
এ হৃদয় ভেঙেচুরে গিয়েছে বহুবার। বহুবার বহুতল ভালবাসা পাতালঘরের জানালা দিয়ে উঁকি মেরে গেছে ফাল্গুনের রাতে। আমি কাঠগোলাপের ছায়া খুঁজে ফিরে গেছি কত কত গাছ আর পাথুরে পথ। আমার হৃদয়ে যে পাশবালিশ অবিকল তোমার দেহের মত জাগন্ত, যে অন্ধ এসরাজের তারে আমি বাঁধা পড়ে আছি অগুনতি বসন্ত মেখে, সেই ঘরে রেখে দিও আমায়। আমার ঘুমন্ত হাতঘড়ি, পঙ্গু ঘুড়ি, বোবা রোদচশমারা জড়িয়ে ধরুক কোনো বরফের চাদর। তোমার সুবাস মাখা আসবাবে থেকে যাক আমার প্রিয় সোয়েটার,মাফলার আর জোয়ানের কৌটো। মশারির সুতোয় লেগে থাকুক আমার সূচ সুতোর ক্ষত। আমার দুঃখ বিলাসী গান, কাটাকুটির ছক, বুড়িমার চকলেট বোম এসবের সুরক্ষিত আশ্রয় হয়ে উঠুক একমাত্র তোমার ঘর। আমার প্রিয় বইয়ের ভাঁজে থাকুক তোমার কলমের দাগ। পার্সের চেনে থেকে যাক তোমার বাড়ি ফেরত টিকিট আর উপহার দেওয়া টিপের পাতারা। ধীরে ধীরে গ্রীষ্মের আগমনে গলে পড়ে যায় বরফের চাদর। অসংরক্ষিত কামরার মত ভিড় বাড়ে আমাদের গতিশীল হৃদয়ে। চোখের তারায় জায়গা করে নিতে থাকে সমস্ত মরশুমি দুঃখ। গতি বাড়ে। জীবন খরস্রোতা হয়ে ওঠে আরও। এ হৃদয় ভেঙে চুরে গেছে বহুবার তবু... ভাঙার ইচ্ছে কমেনি, ভাঙার ইচ্ছে কমেনি তার।
-
আমার মন ভালো নেই। এর মানে কি শুধুই ভালো না থাকা। নাকি তোমাকে ছাড়া ভালো না থাকা। যেভাবে অমাবস্যার আকাশ মন খারাপ করে থাকে চাঁদ হারা হয়ে। সেভাবে মন ভালো থাকে না আমার। যেভাবে জ্যোৎস্না এসে পড়ে আমার ক্লান্ত নাকছাবির ওপর, যেভাবে আলতো হাওয়া ছুঁয়ে যায় আমার ঠোঁটের সরষে তিল। সেভাবে মন খারাপ করে করবী ফুল বর্ষার অভাবে। মন ভাড়া করে থাকা আদর পিয়াসী অজস্র নীল প্রজাপতি। সূর্যের রং আলতার চেয়ে অল্প হালকা হয়। আমার গোড়ালি বেয়ে ঝরে পড়ে গোলাপের পাপড়ি আর নদীর অববাহিকার সংমিশ্রণ। চোখের কাজলে মেখে নি ডানপিটে পলাশের বৃতি। আয়নার পকেটে রেখে আসি আমার চুপি সাজের খেলনা। কপালের টিপে ধরে রাখি অকাল বৃষ্টির কোলাহল। আমি কবিতার মত লিখে রাখি আমাদের অতীত ভাববদল, নিঃশ্বাসের গন্ধ। সবুজের মত উজ্জ্বল আতুঁড়ে ভরে রাখি আমার অনুভূতি। ভোরে কুয়াশায় ঘুম চোখে শুনতে পাই আদরের কয়েন লেনদেন, ঝনঝন শব্দ,প্রিয় গানের স্বরলিপি। তোমায় বোঝাতে পারিনা এত কিছু নিয়ে ভালো থাকা যায় না। ভালো থাকা যায় অল্প অভিমানে, অল্প কথায়। আমি তোমায় বোঝাতে পারি না ভালো নেই মানে শুধু ভালো না থাকা নয় এ যাবৎ। ভালো না থাকা মানে তোমার গন্ধ চাই খানিক।ভালো না থাকা মানে আমার তোমাকে চাই খানিক
-
এই যে রাতের পর রাত আমার থেকে ভাড়া নিয়ে যাও, নিয়ে যাও তারাখসা জ্যোৎস্না। আমি কি তবে ভাগ বসাতে পারি দাবি চাওয়ার খাতায়। তুমি কি তবে ঋণী হতে চাও এই ভাঙাচোরা রাতের উঠোনে। তবে যে রাত ভাঙাচোরা নয় বিধ্বংসী, তছনছ করে যায়, তাদের কথা মনে হয় কখনো? বাড়তে থাকে ঝড়ের গতি, তছনছ করে যায় তারাদের বিছানা তবু ভালবাসা চলে যায় চুপটি করে। সে চলে যাওয়ার গতি ছুঁতে পারে না অমন উন্মত্ত ঝড়। কুঁড়ি ফোটা ভোরে ভিড় করে আসে রাঙা মেঘের ঘনঘটা। সে মেঘের পায়ে বেজে ওঠে ঘুঙুরের শব্দ। বৃষ্টি ছুঁতে চায় এই দগ্ধ মাটির কঙ্কাল। সে জানে ফিরে যাওয়া কঠিন। আকাশের ঘরদোর ছেড়ে সেই মাটি ছুঁতে চায় না কেউ। তবু বৃষ্টি অঝোরে ঝরে পড়ে। শীতল করে দেয় পুড়ে যাওয়া বাদামি মাটি, হলদেটে হৃদপিন্ড, নীলচে ঠোঁটের আস্তরণ। আমি অন্ধকার ঘরে তুলে ধরি প্রদীপের মত চোখের তারা। কপালের টিপ খুলে রেখে দি আয়নার বুকে। দাগ রেখে খসে পড়ে তারাদের মত। এমনই এক লালচে বিকেলে ফুলের বালিশে মাথা রেখে হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে এসে দীর্ঘশ্বাস নেয় এক ঝাঁক প্রজাপতির দল। শান্ত বাতাসে উড়ে চলে যায় জমানো মধু, পরাগরেণু। আর মৃত বন্দর, বাতিল ট্রেন ও সূর্যাস্তের মত পড়ে থাকে আমার ভাড়া দেওয়া রাত, জ্যোৎস্না আদর আর ভাঙাচোরা উঠোনে নিস্তেজ শিউলির গন্ধ।
-
এই আদিম আকাশগঙ্গা মেঘ মেখে থাকে সমুদ্দুরের মত। নৌকায় করে ফিরে গেছে যারা, গাঁয়ে ঘরে, বেঁচে আছে যারা অবসরে, সেই ছোঁয়ায় বাঁচে কত কত রাজহাসের দল। ফিঙে পাখি কুড়িয়ে আনে পলাশের বালিশ। গাছের কোটরে ভরে রাখে শিমুল তুলোর গয়না, দুপুরের রোদ। হাওয়া বয়ে চলে পৃথিবীর অন্তিম শহরে। ভিড় করে আসে আবছা পুঁথির স্তূপ। অন্ধকার ভেঙে যেভাবে বেরিয়ে আসে প্রাচীন সূর্য, যেভাবে মুঠো খুলে দেয় মৃত বন্দর, বহ্নিপতঙ্গ - সেভাবেই ছড়িয়ে পড়ে প্রেমেদের যাদুকাঠি। উপমার মত সত্যি হয়ে ওঠে চৈত্রের আসবাব। ঘাসফড়িং যার ঘরে গিয়ে বসে একান্তে, বলে ফেলে সমস্ত তুলতুলে অভিমান, ভালো থাকুক তাদের ঘরদোর, উঠোনে পড়া বাদামি পাতা। ভালো থাকুক বিকেলের গীতবিতান, সন্ধ্যার ধূপ আর ভালো থাকুক রাতের আকাশে প্রাচীন তারায় মোড়া আকাশগঙ্গা।
-
সারেন্ডার/ বৈশালী:
ভুল করেছি আরেকটা বার আমি/তোমার সুতোর গিঁট খুলেছি আজ,
ক্যানভাসে রং পিছলে পড়ে বলে/আকাশ থেকে পড়ছে খালি বাজ।
আরামদায়ক এই বিকেলের কানে/কুটুস ফুলের দুলের হলো বাস,
আরেকটুদূর এগিয়ে গেলে পরেই/ঘর বেঁধেছে হারিয়ে যাওয়া তাস।
তোমার সাথে যে ভাড়াটে থাকে/তার সাথে আজ হিংসে হলো খুব,
তোমার ছাতা ধার করেছে বলে/জলদি করে সূর্য দিল ডুব।
সকাল বেলায় কুর্তি ধোওয়া জলে/ভাসিয়ে দিলাম উষ্ণ বিলাসিতা,
পড়ন্ত রোদ যেই না ছুঁলো আমায়/বার করে দি বৃদ্ধ গীতবিতান।
রেলগাড়ীদের বড্ড তাড়ার মাঝে/একফাঁকে চোখ ঠিক দেখেছে তোমায়,
ঘুমন্ত মেয়ে যেই না মাখে বিকেল/পাখির নোলক আঁকতে বসে জামায়।
তোমার চোখের অসুখ আমার প্রিয়/সুখ যে আমার সহ্য করা কঠিন,
তোমার করা সমস্ত ভুল বাতিল/আমার কাছে তুমিই শুধু সঠিক।-