এমনই সব একলা রাতে পুরোনো, ফেলে আসা জীবন ফিরে আসে। টুকরো টুকরো সংলাপ, আর কোনোদিনও শুনতে পাবেনা এমন সব কন্ঠস্বর, এক-আধটা আবছা হয়ে আসা মুখ অন্ধকারে বুদবুদিয়ে ওঠে। আবার মিলিয়ে যায়। বাড়ির পিছনে বিস্তৃত জলাভূমি, জলাভূমি পেরোলে রেললাইন। শেষ ট্রেনটার বাঁশি কানে এসে বেঁধে এমন সব রাতে। যেন সুতীক্ষ্ন অনুযোগ জানিয়ে ছেড়ে চলে গেলো আরো একজন। আরামকেদারায় চোখ বুজে রায়ান মনে মনে হিসেব করার চেষ্টা করে পানপাত্র আর ঘুমের ওষুধের মধ্যে কোনটা তার নিকটতর। ইদানীং নিকটতম যদিও মৃত্যুই, তবু এইমুহূর্তে ভীষণ অবসন্ন লাগছে কোনো কিছুর জন্যই এই ঘোর ভেঙে উঠে দাঁড়াতে। দূরে মুসলমানদের পাড়া থেকে কোনো মৌলবির ওয়াজের আওয়াজ আসছে। কথা স্পষ্ট বোঝা যায়না তবে কয়েকবার 'আখেরাত' শব্দটা কানে আসে তার। সময় নিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে শব্দটা উচ্চারণ করে সে। "আখেরাত!" নির্মোহ নিয়তিবাদ। অনেক তাত্ত্বিক কচকচি মুহুর্তের মধ্যে কিলবিলিয়ে ওঠে মাথায়। রায়ান বিরক্ত হয়ে চোখ খোলে। এরপর সে ধীর পায়ে একটা ড্রিঙ্ক বানিয়ে ফিরবে। একসময় পরিপাটি বিছানায় গা এলিয়ে বেড সুইচটা অফ করে দেবে।
নাহ! আজও মরা হলোনা। কাল আরেকবার চেষ্টা করবে সে...-
ভরে নিও আবার।
নিভন্ত ছিলিমে মশলা, ফোনের ব্যালেন্স
এবং মাসকাবারি বাজার।
পৌনঃপুনিক সুখের অভ্যেস।
এক অ্যাড্রিন্যালিন রাস থেকে আরেক
অ্যাড্রিন্যালিন রাস।
প্রতিরাতে নিত্যনতুন সঙ্গিনী ও সঙ্গম,
ভোরবেলা ফ্রুটজুস ও প্রাতঃরাশ।
এভাবেই একদিন ফুরাবো আমি,
ফুরাবে তুমিও।
ততদিন বারবার -
ভরে নিও, ভরে নিও।-
এরকমই অগভীর সমস্ত রাতে কতকিছু ফিরে ফিরে আসে। লিখতে গিয়ে জুঁইফুল আর কত কিছু বলেছি তোমার গায়ের গন্ধকে। কিন্তু আমার ঈশ্বর আর এই রাত জানে সে গন্ধ ঘামের। ঈষৎ বোঁটকা, ঈষৎ নেশা নেশা। তোমার ঠোঁটকে হাজার বিশেষণ দিলেও অগভীর এই রাত মনে করায় তার আসল আস্বাদ। রাবারের মতো। কিঞ্চিৎ আর্দ্রতা যা জিভকে আরো ভিতরে গিয়ে তত্ত্বতালাশের উৎসাহ দেয়। এই যে সঙ্গমের আগের মুহূর্তে তোমার নাকের পাটা কেঁপে ওঠে অবিশ্বাস্য নিশ্চয়তায় খুব গভীর রাত না হলে সে কথা আমি জনান্তিকেও বলতে পারতাম? হাজার নক্ষত্রের রাত নিয়ে কবিতা লেখার মতো কবি অনেক এসেছেন সুলোচনা। সুলোচনা, আমার নরক তুমি। শুধু সেই নরকে গুলজার শুনতে শিখিয়েছিলে বলেই আমার রাতগুলো একশো ষোলা চান্দকি রাতে হয়ে গেলো। কিন্তু সেই কাঁধের তিলটাকে নিয়ে আমি কী করি বলতে পারো? যেসব রাতের গভীরতা মাপতে ভুলে যাই সেইসব রাতে কাঁধে তিল নিয়ে ফিরে এসোনা লক্ষীটি! কথা দাও।
-
আলোতে যেমন থাকে
ভুল বোঝাবুঝি।
তোমাকে ভুলতে চেয়ে আমি
বারেবারে অকাতরে
নিজেকেই খুঁজি।-
তোমায় ভুলিনি প্রিয়।
এখনও মনখারাপ হলে
গুনগুনিয়ে উঠি তোমায়।
যদিও বহতা নদী
আমাদের মাঝে ছলাৎছল...
ফিরতে চাও যদি
বন্ধু আমার , জলকে চল।-
যেভাবে ওম ছুঁয়ে যায় ঠোঁটে
প্রেয়সীর জিহ্বা অথবা চায়ের কাপ।
আমার তবে রইলোটা কী?
ব্যর্থ ও দীর্ঘ এক জীবন,
মায়ামায়া বিষণ্ণ দিন আর
ইতিউতি কিছু বাস্তুসাপ।-
মেহরাজের প্রাতঃকৃত্য সারার জায়গা নেই। সকাল হলে বদনা হাতে সে যেতো মাঠে। পাশের ক্ষেতে ঐসময়ে এসে বসতো পুবগাঁয়ের সুবল দোলুই। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে দিতে দেশ-দুনিয়ার কথা, সুখ-দুঃখের কথা হতো দুই বন্ধুর। এ তাদের না হোক বছর তিরিশের অভ্যাস!
এখন সেই মাঠ দিনরাত টহল দিচ্ছে সেপাইরা। ন্যাড়া করে খুঁটি পুতছে কাঁটাতারের। দেশভাগ হচ্ছে। বাপ পিতেমোর ভিটে ছেড়ে যেতে হবে। তবে সে ভাবনা কালকের। আজ মেহরাজ ভাবিত সে কাজটা সারতে যাবে কোথায়? অনেক দুরের বড় শহরে বসে দুই রাষ্ট্রপ্রধান তার আর সুবলের জমিতে প্রাতঃকৃত্য সারছে এখন।-
ছাপ রেখে যেও প্রিয়!
মিলনের এই ক্ষণিক শীৎকার!
আমার বেদনা তোমার করে নিও।-
চাদর জড়িয়ে কুয়াশা ঘুম।
ঘোর পেরোতেই কাটলো বিকেল,
রেডিওতে 'এক ম্যায় অউর এক তুম ...'
সন্ধ্যে নামে রাত্রিশেষে,
মায়ার খেলা শহরজোড়া।
নেশার শরীর দিচ্ছে পিষে,
প্রেমিক তোমার। বর্ণচোরা।-
এভাবেই বেঁচে থাকা!
না মরে, না মেরে
দিনগত পাপক্ষয়।
সুদিনের স্বপ্ন দেখা।-