মেঘা আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল। এ কাকে দেখছে! ঠিক দেখছে তো? অবিকল সেই চেহারা! লম্বা! বলিষ্ঠ! কোন মায়াবলে এখানে উপস্থিত হলো আকাশ! বিপুল দেহ, মেদ ভরা গাল হয়ে গেছে। গলা চিবুক সবকিছুকে ছাপিয়েও ও মুখ পলকে চিনে ফেলা যায় এত বছর পরেও।
মেঘা সামনে যেতেই চোখে চোখ পড়ল। যেন একটা আস্ত পাহাড়ের সামনে এক ফালি মেঘ দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকাশেরও চিনতে এতটুকু সময় লাগল না। অজস্র কথা চেপে রেখেই মুখে হাসি ফোটাল আকাশ। মেঘাও মৃদু হাসল। হাসির আড়ালে কান্নাটা গোপন রেখেই আকাশ বলেই ফেলল, - কেমন আছো মেঘ?
মেঘা প্রস্তুত ছিলনা। তবু কোনরকমে বলল, - 'আছি। ভালো আছি। আজ একটু তাড়া আছে। আসি।' আর সময় না দিয়ে মেঘা অতিক্রম করে যায় আকাশকে। আকাশের মুখ থেকে আচমকা হাসি মুছে গেল। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো। আবারও কি মেঘার ছলনা ধরে ফেলল আকাশ?
পাহাড় কি বুঝে গেল উড়ে যাওয়া মেঘ আর ফেরে না কখনও!
একে রাতে লোডশেডিং, তার ওপর গুমোট আকাশ। মেঘ ঘনিয়েই ছিল হয়তো। টের পায়নি কেউ। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে এল।-
একটা পাতায় কিছু লেখো, সবাই মন দিয়ে পড়বে..."
লিখতে ভালোবাস... read more
শহুরে আদবকায়দায় মানুষ হয়নি সদানন্দ। বরং গ্রামের স্নিগ্ধ নদীর ধারে খোলামেলা পরিবেশে হেসে খেলে বড়ো হয়েছে সে। কিন্তু শহরে তাকে যেতে হচ্ছে এখন কলেজে ভর্তির জন্য। গ্র্যাজুয়েট না হলে চাকরি পাবেনা, আর চাকরি না পেলে মায়ের কষ্ট দূর করবে কি করে! মা ছাড়া সদানন্দর আর আছেই বা কে!
কলেজে অ্যাডমিশন হয়ে গেছে। ক্যান্টিনে বসে একমনে তার বাড়ির কথা মনে পড়ছিল। সেই ধানক্ষেত, স্নিগ্ধ নদী, বকুলতলা আর মা। হঠাৎ সব নিভে গেল টেবিলে ঠক করে রাখা চাউমিনের প্লেটের আওয়াজে। কাঁটা চামচের ব্যবহার কোনদিন সে করেনি। কিন্তু মানিয়ে তো নিতে হবে। কাঁটা চামচ দিয়ে চাউমিন মুখে তুলতে গিয়েই অনর্থ ঘটল। ছিটকে গেল কাঁটা চামচ, চাউমিন গায়ে পড়ে গেল। গোটা ক্যান্টিনটা যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। অসংখ্য ছেলেমেয়েদের কোলাহল থেমে গিয়ে সবার দৃষ্টি এখন একজনেরই ওপর। কেউ কেউ যেন হাসতে গিয়েও হাসতে পারছে না। এক বিষন্ন স্তব্ধতা যেন ঘিরে ধরল সদানন্দকে। বাড়িতে মায়ের হাতে খাইয়ে দেবার কথা মনে পড়ে যেতে লাগল।
এক নিমেষে ঝাপসা হয়ে এল চাউমিনের প্লেটটা।-
গ্রামের নিমাই মাস্টার ছাড়পত্র হাতে পেয়ে গেলেন। আগামীকালই ওনার করজগ্রাম বিদ্যাপীঠে অন্তিম দিন। শুধু করজগ্রাম বিদ্যাপীঠই নয়, আগামীকাল নিমাই মাস্টার করজগ্রাম ছেড়েও বোধহয় চলে যাচ্ছেন। আর থাকবেই বা কেন! যে স্কুলটার উন্নতির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে আজ একটা জায়গায় দাঁড় করালেন, শুধু তাই নয় দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীগুলোকে পাঠাগার থেকে বিনামূল্যে বই দিতেন, শ্লেট চক পেনসিলও বাদ যেত না। গত কয়েকবছর ধরে নিজের অর্ধেক বেতন স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিতেন স্কুলের উন্নতির জন্য। এবং অনেক ছাত্রছাত্রীদের বেতনমুক্ত করে দিয়েছিলেন যারা আজও দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করে। কিন্তু এভাবে শিক্ষা চললেও স্কুল তো আর চলতে পারেনা। আজ সেই উপরমহল থেকেই আদেশ এল ওনার এবার একটা লম্বা ছুটির জন্য ছাড়পত্র অনুমোদন করা হোক।
আজ ছুটির পর যখন স্কুল ফাঁকা হয়ে গেল ছাড়পত্রটা হাতে নিয়ে স্কুলটা ছাড়ার আগে ছলছল চোখে চারিদিক একবার ঘুরে দেখতে লাগলেন নিমাই মাস্টার। ফাঁকা ধূ ধূ স্কুলটাতে শুধু একটা চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। আষ্টেপৃষ্টে কারা যেন নিমাই মাস্টারের পা দুটো ধরে রাখতে চাইছে। হাতের মুঠোয় ধরে থাকা কাগজের ছাড়পত্রটা আজ যেন লোহার থেকেও বেশি ভারী মনে হচ্ছে নিমাই মাস্টারের।-
রিভুর আজ সতেরো বছর পূর্ণ হল। ছোট থেকেই রিভু কথা বলতে পারে না, কানেও শুনতে পায়না। রিভুর যা কিছু বলার সবটাই ইশারাতে। আর সে ইশারা রিভুর মা-ই একমাত্র বোঝে। আজ রিভুর মা ছোট করে একটা আয়োজন করেছে বাড়িতে। নিকট আত্মীয় বলতে কেউই নেই। কাছেপিঠের কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। দুপুর গড়াতেই লোকজন আসতে শুরু করেছে। রিভুর মা একার হাতে সবকিছুর জোগাড় করছে, তাই ওর মায়ের একদন্ড আজ সময় নেই। রিভুকে একে একে সবাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে হাতে উপহার তুলে দিচ্ছে। রিভু সেগুলো রেখে দিয়ে আবার উদাসীন ভাবে জানালায় তাকিয়ে। হঠাৎ রিভুর এক গোঙানির শব্দ শুনতে পায় সকলে। বিচিত্র ভঙ্গিতে হাত পা নেড়ে কিছু একটা ইশারা করতে থাকে। কেউ কেউ কাছে এসে বলে, কিছু চাইছ রিভু? কিন্তু রিভুর কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ রিভু একমাত্র ইশারাটাই বোঝে। একজন রিভুর সামনে এসে ইশারায় দেখায় বাথরুমে যাবে কিনা। কিন্তু রিভু ক্রমশ হাত পা ছুঁড়তে থাকে বিছানায়। হাত নেড়ে এক অদ্ভুত ভঙ্গিতে কাউকে ডাকছে বোধহয়। সাথে সাথে রিভুর মা কে ডাকতেই ওর মা দৌড়ে থালা নিয়ে আসে। ডাল ভাত চটকে মেখে রিভুর মুখে গ্রাস পাকিয়ে তুলে দেয়। আশ্চর্য এক স্বস্তি ছড়িয়ে পড়ল যেন। সঙ্গে সঙ্গে কমে গেল রিভুর অস্থিরতা।
সকলে অবাক। নির্বাক। একমাত্র এরাই দুজনে পরস্পরের ইশারা বোঝে। ঈশ্বরও এক বিচিত্র বাঁধন যেন গড়ে দেয় মা ছেলের মধ্যে, যা এই দুর্বোধ্য ভাষাগুলোও পড়তে শেখায়।-
- কতদিন পর এখানে এলাম বলত! প্রায় পাঁচ বছর পর। কতকিছু চেঞ্জ হয়ে গেছে রে অভি।
- হ্যাঁ, আগের মতো আর কিছুই নেই। সবকিছুই পাল্টে গেছে রে!
- আচ্ছা। চল একটু ঘুরে আসি শহরটা। গাড়িটা বের করছি দাঁড়া। তারপর যেতে যেতে বাকি কথা হবে।
(গাড়িতে উঠে..)
- তারপর তোর কাজকর্ম কেমন চলছে এখানে?
- ওই চলে যাচ্ছে। মা বাবার শরীরটাও ভালো নেই। যাক গে তুই বল। বিদেশে গিয়ে তো একদম সাহেব বনে গেছিস!
- আরে না না। আমি তো এখানেই..(হঠাৎ সজোরে ব্রেক কষে) দেখলি দেখলি পাগলটার কাজ! কেমন গাড়ির সামনে চলে এল। ঠিক সময়ে ব্রেক না কষলে এতক্ষণে..
- মরে তো ও কবেই গেছে। আর কতবার মরবে!
- কি! কি সব বলছিস তুই অভি! তোর মাথাটাও দেখছি গেছে। এনিওয়ে ওই পাগলটাকে নেমে সরা তো। ডিকিতে স্ক্র্যাচ্ না ফেলে দেয়!
- চিন্তা করিস না ও তোর কোন ক্ষতি করবে না।
- আচ্ছা? তুই দেখছি পাগলটাকে খুব ভালো চিনিস!
- শুধু আমি না সন্তু। তুইও চিনিস খুব ভালো করে।
- মানে? কি বলছিস টা কি অভি? আমি তোর কোন কথাই বুঝতে পারছি না।
- তুই যাকে পাগল বলছিস সে আমাদের বন্ধু নিলয়। ভালো করে তাকিয়ে দেখ। সাত বছরেরও বেশি তোর বোনের সাথে সম্পর্ক ছিল। তারপর তুই তোর বোনের বিয়ে দিয়ে বিদেশে চলে গেলি। আর তারপর নিলয়..
- ওহ মাই গড! কি বলছিস তুই!
- ভালো করে তাকিয়ে দেখ সন্তু পাগলটার দিকে।
নিলয় কে দেখতে পাচ্ছিস?
(পাগলটা হঠাৎ ছুটতে থাকে)
- নিলয় দাঁড়া। দাঁড়া নিলয়। নিলয়? নিলয়?-
শুধু আমরা দুজনেই জেগে আছি ভোর দেখার অপেক্ষায়। একসাথে। কিন্তু অপেক্ষারাও ক্লান্ত হয়। মানুষটাও রাত জেগে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শান্ত দীঘির পাশটাতে। তারপর বোধহয় একসাথে ভোর দেখা হয়ে ওঠেনি কখনো। পাশাপাশি বসে না বলা কথাগুলো একের পর এক দীঘির কালো জলে পাক খেতে থাকে। বড় বেমানান লাগে, মনে হয় এভাবে থেকে যাওয়ার চেয়ে ফিরে যাওয়াই ভালো। ফিরে যাওয়াই যেত, কিন্তু তাও থাকতে ইচ্ছে করছে শুধু দুঃখকে ছুঁয়ে দেখার জন্য। আচ্ছা এই সময়টাকে আটকে রাখা যায় না? এই যে আমরা বসে আছি পাশাপাশি, আশ্রয় খুঁজছি, আঁকড়ে ধরতে চাইছি, কিন্তু আলো ফুটছে না। এটাই কি মুক্তি? অবশ্য অন্ধকারে না চিনতে পারাই ভালো। পুনর্জন্ম আমি বিশ্বাস করিনা। আমি মিথ্যা বোঝাইনা নিজেকে। আমি সৎ।
ভালোবাসি? কে জানে ওভাবে কি বলা যায়!-
চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দায়। ইমন হাত পা গুটিয়ে বসে আছে বেতের চেয়ারে। গাঢ় অন্ধকার আর অসীম শূন্যতা নিয়ে ইমনের এখন গোটা পৃথিবী। এক বছর আগেও ইমনের গোটা দুনিয়াটা রঙিন ছিল। দু চোখ ভরে দেখত আকাশ, চাঁদ, গাছপালা, পাখি। এখন দিন হয়, রাত্রিও হয়, কিন্তু ইমনের কাছে সবই এখন রাতের নিকষ কালো অন্ধকার। এক বছর আগে গাড়ি চালাতে গিয়ে গুরুতর ভাবে জখম হয় ইমন। ভগবান সবথেকে দামী জিনিসটাই কেড়ে নেয় ওর কাছ থেকে। ইমনের চোখ দুটো। অনেক ডাক্তার দেখানো হলেও শেষ জবাব একটাই, আর কোনদিনই ইমন দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাবে না। যে ইমন ছোটবেলায় অন্ধকারকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেত, বাড়িতে লোডশেডিং হলে মা - মা করে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে দিত। সেই ইমন আজ নিজেই অন্ধকারের দুনিয়াতে বাস করছে। ইমনের কি এখন ভয় করে? মা - মা করে চেঁচিয়ে ডাকতে ইচ্ছে হয়? ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগল ইমনের। এই হাওয়া যে ওর খুব চেনা। আগে এরকম হাওয়া গায়ে লাগলেই আকাশে চেয়ে দেখত ইমন। দেখত কালো মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ। এখনও বোধকরি তাই হবে। ঝড় উঠতে পারে। ইমন ধীরে ধীরে উঠে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায়। বিদ্যুতের ঝলকানি দেখেই যে আগে কানে হাত দিত। এখন শুধু শব্দ আর শব্দ। বাজের শব্দ, ঝড়ের শব্দ। কান ঝালাপালা হয়ে যায় ইমনের।
কখন সকাল হয় ইমন বুঝতে পারেনা। তবে গায়ে সূর্যের তাপ লাগলে বুঝতে পারে। বেতের চেয়ারে হাত পা গুটিয়ে বসে আবার অপেক্ষা করতে থাকে একটা রাতের..
-
অসময়ে
ঢেউ এর পর ঢেউ পেরিয়ে ক্রমশ ভেতরদিকে এগিয়ে চলেছে মাধবী আর শান্তনু। ঢেউ আসার সঙ্গে সঙ্গে শান্তনু বলিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাধবীর কোমর ধরে জলের মাথায় লাফিয়ে উঠছে। কিন্তু মাধবী তাল রাখতে পারছে না। লাফাতে গিয়ে এদিক ওদিক হয়ে যাচ্ছে সময়। সমুদ্রে হুটোপুটি করে ভেজা বালির ওপর হাঁটু মুড়ে বসে অনন্ত জলরাশির দিকে তাকিয়ে রইলো মাধবী। অনেক দূরে শান্তনুর শরীর টলমলে জলে ভেসে উঠছে শুধু। হঠাৎই মাধবীর চোখ আটকে গেল একজনের দিকে। আবীর না? একটা মেয়েকে কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে এক একটা ঢেউ এর দস্যি ঝাপটাকে সামাল দিচ্ছে। মুহূর্তে এক ঠান্ডা হিমস্রোত বয়ে গেল পুরো শরীর জুড়ে। আবীর এখানে? আর কোলেই বা কে? নিশ্চয়ই মেয়ে। কি ফুটফুটে। আবীর বিয়ে করে নতুনভাবে যে বাঁচছে এটাই বা কম কিসের। কিন্তু এই অসময়ে কেন দেখা হলো আবার? একটা বড়ো ঢেউ এলো। দুরন্ত জল ঝাঁপিয়ে পড়লো বুকে, কোমরে। তাল না সামলাতে পেরে আরও খানিকটা পিছিয়ে গেল মাধবী ভেজা বালির ওপর।
পরদিন খুব ভোরে অন্যমনস্কভাবে মাধবী সমুদ্রের তীরে হাঁটছিল। আবীরের সাথে এই অসময়ে দেখাটা না হলেই তো পারত। আবীর অবশ্য মাধবীকে লক্ষ্যই করেনি। যে মানুষটার নাকি একটা দিনও তাকে ছাড়া চলত না। সুখের মুহূর্তগুলো কত তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায়। হঠাৎ শান্তনুর মুখটা ভেসে উঠল। মনটা হু হু করে উঠল মাধবীর।
মাধবী এগিয়ে পা ছোঁয়ালো জলে। গড়ানে আকাশের গায়ে সূর্য তখন আবার নতুন করে আলো ছড়াতে শুরু করেছে।-