— এবারে বসন্তকালে ক্ষয় দেখেছো ?
— ক্ষয় ?
— হ্যাঁ! ক্ষয় ! বুকের ভিতর যে ক্ষয় হয়েছিল, বসন্ত এসে সিগারেটের ধোঁয়ায় উড়ে গিয়েছিল, রাস্তার ধারে ধারে দূরবীন দিয়ে কেউ কোকিল খুঁজেছিল, ভিক্ষে করেছিল গুটি বসন্তে কানা হওয়া চোখে কেঁদে কেঁদে এগুলো সবই তার ক্ষয়। তার ছেড়া ঘুড়ির মতো করে যখন লুটিয়ে পড়েছিলাম আমি, ন্যাতিয়ে গেছিল বনমালতিরা বনলতা সেনের পায়ের কাছে, আর তখন বন্দুকের নলের ভিতর ভরা এক দাবানল ভালোবাসা এসেছিল ক্যামন, আর সেই আগুনে গা পুড়িয়েছিলাম আমি, ঝলসে গেছিল বুক, মাথা, ঊরু। এসবও তো ক্ষয়। ক্ষয় হয়েছিল, ক্লান্ত সিপাহীর তরোয়ারিতে নিহত হওয়া হায়নার মতোন ক্ষয় হয়েছিল, পড়েছিলাম আমি থিকথিকে স্নিগ্ধ সবুজ ঘাসের উপর মৃতের শরীর নিয়ে, আমার নিথর দেহর উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ডোম, উড়ে যাচ্ছিল জোনাকি, আর চারটে শিশু হরিণ শাবক আমি জীবিত নাকি মরা এই নিয়ে তুমুল ঝগড়া করতে করতে জল খেতে আসছিল তখন নদীর ওপারে, কুলুকুলু কুলুকুলু শব্দ বইছিল জলের, হাওয়া দিচ্ছিল আর সেগুন পাতার উপর ভর করে বসেছিল এক চড়ুই। বুকের ভিতর তখন রক্তাক্ত হচ্ছিল এক হৃদয়। এক প্রেমিকের ঝলসে যাওয়া ছা পোষা এক হৃদয়। আর আমি তখন ফেরেশতাদেরকে ডেকে ডেকে বলছিলাম আমার ভীষন রকম বাদশাহী ঘুমের জন্য দু চোখ বুজে শোবার কবরটা এবার একটু খুঁড়ে দিয়ে যেতে।

-

— ওভাবে তাকিয়েছিলে ক্যানো তখন কৃষ্ণচূড়া গুলোর দিকে ?

— লাল! লাল দেখব বলে!

— লাল ? ক্যানো? কি এমন আছে ওই লালে যাকে এমন ভাবে দেখা যায়?

— রক্তাক্ত একটা বুক আছে, শিরদাঁড়া মচকানো তরুণীর রক্ত মাখা আহত এক হৃদয় আছে, সংসারের অভাবে প্রতি মাসে বিক্রি করা এক পিতার রক্ত আছে, এক প্রেমিকের গড়তে না পারা সংসার আছে, লাল রুমালে মোছা কান্না আছে আর আছে অনেক লাল। অনেক অনেক লাল। আর এই অনেক অনেক লালে ক্লান্ত সিপাহীর তরোয়ারিতে আঘাত পাওয়া নিহত হায়নার মতো করে আমি নিজেকে যেন এক পৈশাচিক রক্তে রক্তাক্ত করে তুলছিলাম কৃষ্ণচূড়ার মতো নির্লজ্জ বেদনাময়ী লা-ল হবো বলে ।

-

ভেতর ঘরের প্রদীপ
_________________
মনের প্রদীপ নিভছে যখন ভীষন ঝড়ে
ভেতর ভেতর চলছে তখন হাওয়ার লড়াই
মনের কসাই মনের ভিতর কাটছে এ মন
বিনা মেঘে বাজ পড়েছে বৃষ্টি ছাড়াই।


আঁধার হলো কাজলা মেয়ের পিদিম তলা
পিলসুজেরাও জ্বলতে চেয়ে অব্যাহত
তবুও কেন নিভে গেল প্রদীপ শিখা
কার চোখেতে ভিজে গেল পলতে যত !

তবুও আমি দাঁড়িয়ে আছি দু হাত তুলে
দু হাত জুড়ে জড়ো করে পোড়ার ক্ষত
মনের ভিতর হৃদয় খুনের দীপাবলি
হৃদয় পোড়ার শব্দে ফাটে পটকা যত

চোখের জলে নিভে গেছে আগুন প্রদীপ
তবুও হিয়া জ্বলছে দেখো অহরহ
মনের ঘরের আগুন নেভা প্রদীপ শিখায়
নিজের হাতেই নিজের হৃদয় করবো দাহ।

-

- ভালো আছো ?
এক বধিরকে জিজ্ঞেস করলাম - ভালো
আছো ?
সে বলল - না সে ভালো নেই, কোনো এক
চিলে নাকি তার কান নিয়ে গেছে, তাই সে
ভালো নেই।

এরপর আকাশের দিকে তাকিয়ে এক
মেঘকে জিজ্ঞেস করলাম - ভালো আছো ?
সে বলল - না, সে ভালো নেই, মেঘ না
চাইতেই খুব বৃষ্টি নেমেছিল আজ,
তাই সে ভালো নেই।

এরপর আমি সন্ধ্যার চাঁদকে জিজ্ঞেস
করলাম - তুমি ভালো আছো ?
সে বলল - না, সেও নাকি ভালো নেই, ও
পাড়ার এক বামন নাকি বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত
বাড়াতে গেছিলো তাই সেও ভালো নেই।

এরপর আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করলাম
- তুমি কেমন আছো ?
তুমি বললে তুমিও ভালো নেই,
উড়ে এসে জুড়ে বসা পাখির মতো আমি
তোমার ডালে বাসা বেঁধেছি
বলে তুমিও আজ ভালো নেই !

-

তোমার যত সাবেকি হুকুম ইতিহাস শরীরে
আমার আকাশে চাঁদ হয়ে তুমি ফিরে এসো বারে বারে
আমার যে চোখে সুরমা ঘেটেছে ধুয়ে দিয়ে সুনামি,
আমার দু হাতের মেহেন্দির লালে ঈদ হয়ে এসো তুমি।

-

শব্দ করে কারে করো ব্যথার নালিশ ?
কেউ কি আছে এসব কিছু শোনার তরে ?
বুকের ভিতর রক্তে ভাসা আলবেনিয়ান
শুধু তুমিই বোঝো তোমার ব্যাথা তোমার করে ।

সেই টেলিফোন আদৌ কি কাল এসেছিল ?
যেই টেলিফোন আসার কথা মধ্যরাতে
নাকি সেই বালিকা ভুলেই গেছে ফোন লাগাতে
অকাল শ্রাবন ঝরিয়ে দিয়ে আমার রাতে।

-

চাঁদের শরীরের মতো নিজেকে পুড়িয়ে
মেলে ধরলাম তোমার মুখের কাছে,
আর তাতে এক চিমটে নুন মাখালে তুমি,

কয়েকবার ফুঁ দিয়ে
কামড় দিলে
আর তারপর আস্তে আস্তে আমি অর্ধেক
হতে শুরু করলাম তোমার মুখের ভিতরে।

-

ভিখিরির প্রথম রমজানের খুচরো পয়সার
মতো করে নিজেকে ছড়িয়ে রেখেছিলাম
তোমার ঘরের মাদুরে,
ঠিক সেইমতোই তুমি জল তুলে বালতিটা
রেখে ঘরে ঢুকতে গিয়ে হোঁচট খেলে
আমার গায়ে
আমি ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলাম তোমার পায়ের
সৌখিন নখের আঘাতে।

অতঃপর
অজান্তেই পা মাড়াতে গিয়ে থমকে দেখলে তুমি
আমি শুয়ে আছি দরজার কাছটায়
খুচরো পয়সার মতন নিজেকে
বিছিয়ে

তুমি এক এক করে সব খুচরো
পয়সাগুলোকে কুড়িয়ে বেঁধে নিলে
তোমার শাড়ির আঁচলে
অতঃপর
আমি বুঝলাম, বড়লোকদের কড়কড়ে
নোটের পাশে আমার দর এখন বেশ কমে গেলেও,
তোমার আঁচলের খুঁটে এখনো আমার দর কিন্তু
আগের থেকে একটুও কমেনি।

-

তোমাকে মায়ের মত করে অভাব বলতে
চেয়েছিলাম
কিন্তু তুমি মইয়ের উপর মই চাপিয়ে উঠে
গেল বহুদূর — আকাশ ছুঁতে।
লাল সূর্যাস্ত ছুঁতে।

আমি তোমাকে বলেছিলাম নেমে এসো,
মাটির কাছে এসো,
পথের কাছে এসো
কিন্তু তুমি আসোনি। তুমি বলেছিলে —
তুমি অভাব বোঝো না, তুমি কষ্ট বোঝো
না, তুমি বোঝো শুধু আয়োজন।
আয়েস আর বিলাসিতা।
তাই তুমি এবার থেকে আকাশের কাছেই
থাকবে, কারণ মাটির কাছে নেমে এলেই
সব আয়োজন ধুলো হয়ে যায় ।

-

হৃদয় যখন মনের মানুষ জখম করে
তীরের ডগায় রক্ত লাগে বুকের ভিতর
তবুও যেন অদৃশ্য এক কথার ফলক
হাওয়ায় ওড়ে রাঙিয়ে দিয়ে বিষাদ প্রহর।

দুঃখ দিলে উড়িয়ে দিও বালির মতন
উড়িয়ে দিও এক মহাকাশ শব্দ করে,
সাহারাকে জিজ্ঞেস করো সুযোগ পেলে—
সে ক্যামন করে শরীর পোড়ায় বালির ঘরে।

চোখের কোণের নবজাতক অশ্রুগুলো
উথাল পাথাল বয়ে যাওয়ার হদিশ করে
তবুও যেন এক পশলা বৃষ্টি হলে
উথাল পাথাল নদীগুলোও স্রোতে ফেরে।

-