মোবাইল স্ক্রিনে হঠাৎ কৌস্তভের নামটা দেখে ত্বনীর বুক কেঁপে উঠলো। দুদিন হলো অফিসের কাজে ও দিল্লি এসেছে। যতদুর জানে খুব দরকার না পড়লে কৌস্তভ বা শান্তনু ওকে এই ব্যস্ততায় কল করেনা। ফোনটা ধরতেই কৌস্তভ তাড়া লাগিয়ে বললো, "এই শোন, তোর দিল্লির হোটেলের পুরো ঠিকানা দে তো। হোয়াটসএপে লোকেশন পাঠা।" ত্বনী অবাক হয়ে বলল, "সেটা দিয়ে তুই কি করবি?" কৌস্তভ রাগী গলায় বলল "বড্ড প্রশ্ন করিস তুই। কাজ আছে বললাম তো। আমার এক কলিগের জন্য।"

ত্বনী হোয়াটসএপে লোকেশন পাঠিয়ে সবে ল্যাপটপটা খুলেছে, ওর দরজা কেও ধাক্কা দিলো। "রাত এগারোটা তেও শান্তি নেই", মনে মনে গজগজ করে ত্বনী দরজা অল্প খুলে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো "হনুমানগুলো তোরা এখানে কি করছিস?" শান্তনু আর কৌস্তভকে ত্বনীর হাত থেকে বাঁচাতে পেছন থেকে চিন্টু বেরিয়ে এসে বললো, "তুমি একা একা ঘুরে বেড়াবে সেটা কি আমাদের সহ্য হয়? কাল তোমার কাজ শেষ হলে আমরা সবাই দুদিন দেহরাদুন তোমার বোনের কাছে ঘুরে আসবো।" ত্বনী কোনো প্রতিক্রিয়া দেবে কি !! তার যে তখন চোখে জল !!

-

"দেখোনা এই হনুমানগুলো কি কান্ড বাধায়। আমি আর পারিনা বাপু।" কাঁদো কাঁদো গলায় ত্বনী বললো চিন্টুকে। চিন্টু উত্তর দিলো, "তুমি একটু ঠান্ডা হও। তারপর বলো কৌস্তভ কোন হাসপাতালে ভর্তি।" দুজনে ছুটলো বাইপাসের ধারে পিয়ারলেস হাসপাতালে। সদ্য শেখা বাইক চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পা ভেঙে কৌস্তভ ওখানেই ভর্তি। ভাগ্গিস শান্তনু তখন সাথে ছিল। তাই ওই নিয়ে এসেছে হাসপাতালে। ওর নিজের সামান্য চোট লেগেছে। কৌস্তভের পায়ের ওপরে তার সাধের বাইক পুরোটা পড়ায়, এখন ঠ্যাংটি ভেঙে তিনি ভর্তি হাসপাতালে। ওর মা বাবা থাকেন সেই বর্ধমানে। এখনো এসে পৌছাননি।

হাসপাতালে পৌঁছে ত্বনী কৌস্তভ কে এই মারে তো সেই মারে। শান্তনু অনেক কষ্টে ওকে আটকালো, "ওরে দাঁড়া। তুই কি ওর শরীরের একটা হাড় ও আস্ত রাখবি না?" ত্বনী রেগে কৌস্তভের পিঠে একটা কিল মেরে বললো, "তোর দ্বিতীয় পা টাও আমি ভেঙে রেখে দেব। বাইপাসে বেশি ওস্তাদি মারা বার করবো।" ঠিক করা হলো হে রাত্রে শান্তনুকে বাড়ি পাঠানো হবে জোর করে। ডাক্তার একরাত observation এ রাখতে চেয়েছেন। তাই চিন্টু রাতে থাকবে কৌস্তভের সাথে। Visiting Hours শেষ হওয়ার পরে যাওয়ার আগে ত্বনী আরো একবার কৌস্তভকে বকে, সকালে আসবে জানিয়ে, শান্তনুকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। আজ রাতে শান্তনুও থাকবে ত্বনীর বাড়ি। ওর observation এ।

-

"তোরা শুধু প্ল্যান বানা। গোয়া যেতে হবেনা আর কোনোদিন।" তন্বী রেগে উঠে যাচ্ছিল ওদের রোজের সান্ধ্য আড্ডা থেকে। শান্তনু হাত ধরে আটকে বললো, "আরে ক্ষেপছিস কেন? বললাম তো এবারের অফিসের বোনাস এলেই আগে গোয়ার টিকিট কাটবো।" চিন্টু আর কৌস্তভ সমস্বরে বলে উঠলো, "হ্যা হ্যা। একদম।"

তিন মাস বাদে দক্ষিণ গোয়ার নিরিবিলি সমুদ্র সৈকতে ওরা চার বন্ধু যখন মন খুলে আড্ডা দিচ্ছিল, তন্বীর মনে হচ্ছিল কোনো নিজস্বী বা ছবিতে এই মুহূর্ত সঠিক ভাবে ধরা যায়না। এগুলো ওদের বন্ধুত্বের স্মৃতির খাতায় স্বমহিমায় বিরাজমান।

-

প্রিয় শান্তনু,

শুভ জন্মদিন। তুই আমার জীবনে এক অদ্বিতীয় মানুষ। একদিকে তুই যেমন আমার ভাই। আরেকদিকে তুই আমার সবচেয়ে প্ৰিয় বন্ধুদের মধ্যে একজন। তোর-আমার সম্পর্কটা তাই অতুলনীয়।

জীবনে চলার পথে আমরা সুখ দুঃখে একজন আরেকজনকে পরম মমতায় আগলেছি। ঝগড়াও করেছি প্রচুর। তবু আমাদের সম্পর্ক অটুট থেকেছে কারণ আমাদের একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা, স্নেহ আর বিশ্বাস।

তোকে বলার মতো অনেক কথাই জমে আছে। সেটা এই স্বল্প পরিসরে কুলোবে না। আজ শুধু এইটুকু বলতে চাই যে এভাবেই যেন আমরা সারাজীবন একে অন্যের পাশে থাকতে পারি। তোর মতো এত যত্নবান এক বন্ধু-ভাই পেয়ে নিজেকে সত্যি খুব ভাগ্যবতী মনে করি।

ভালো থাকিস ভাই। সুস্থ থাকিস।

ইতি,
দেবস্মিতা "দি"

-

জবর খবর- ১

আজকের সান্ধ্য আড্ডাটায় যেন এক গুরুগম্ভীর আবহাওয়া। কৌস্তভ আর শান্তনু আগেই এসে পড়েছে বটে, কিন্তু ওদের জগুদা স্পেশাল চিকেন উইংস এখনো অর্ডার দেওয়া হয়নি। এমনকি তন্বীর টিপ্পনীও যেন গায়ে মাখছে না ওরা। অবশেষে রেগে মেগে তন্বী বললো, "এই তোদের কি হয়েছে কি বলবি? তখন থেকে হুঁকোমুখো হ্যাংলা সেজে বসে আছিস কেন রে হনুমান গুলো?"

ইতিমধ্যে চিন্টুর আবির্ভাব হলো আড্ডায়। এবার শান্তনু একটু গলা খাকরে বললো, "কৌস্তভ বলেই দে এবারে সুখবরটা।" কৌস্তভ অন্যমনস্ক উত্তর দিলো, "কেন তুই বল না।" সুখবর দিতে এত গম্ভীর কেন হতে লাগে সেটা তন্বীর বোধগম্য হলোনা। তন্বীর উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকিয়ে ওরা হো হো করে হেসে উঠলো।

কি সেই সুখবর? আদৌ কোনো সুখবর আছে কি? নাকি এটাও কৌস্তভ আর শান্তনুর কোনো মিচকে দুষ্টুমি? জানাবো পরের পর্বে।

(চলবে)

-

প্রিয় কৌস্তভ,

শুনেছি ছোটবেলার বন্ধুত্বর মতো দৃঢ় বন্ধন আর হয়না। যারা বলে, তারা তোর-আমার বন্ধুত্ব দেখেনি। অনেকটা বড়বেলায় যখন আমাদের দেখা হলো, আলাপ শুরু হলো ঝগড়া দিয়ে। সেদিন জানতাম না ঝগড়ার বাহানায় এক জীবনভরের বন্ধুকে পেতে চলেছি।

তারপর অফিসের কাজে একসাথে পাঞ্জাব যাওয়া, পুরোটা সময় তোর আর শান্তনুর সাথে কাটানো। তোর মনে আছে আমাদের অমৃত্সর যাওয়া? সেদিন ফেরার পথে রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করেছিলাম যে তুই আমার কতখানি ভরসা যোগ্য বন্ধু। নিজেকে খুব ভাগ্যবতী মনে করি যে পাঞ্জাবের ওই দুই মাস আমায় সারা জীবনের জন্য এক সেরা বন্ধু চিনতে সাহায্য করেছিল।

তারপর তো অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। কালের নিয়মে, ভৌগোলিক দূরত্বে, দেখা হয়তো আগের মতো হয়না। কিন্তু আমার বিশ্বাস আমাদের বন্ধুত্ত্বের দৃঢ়তা তাতে কিছুমাত্র কমেনি। বরং হয়তো বেড়েছে।

আজ তোর জন্মদিনে কথা দিলাম আবার, সুখে দুঃখে বন্ধু হয়ে পাশে ছিলাম, আছি, থাকবো। বন্ধুত্বের হাত আজ আরো শক্ত করে ধরলাম।

শুভ জন্মদিন। খুব ভালো থাকিস।

ইতি,
দেবস্মিতা।

-

"কি ব্যাপার? আজ কৌস্তভ এত চুপ চাপ কেন রে শান্তনু?" সারাদিনে যে যার অফিস সেরে প্রত্যেকদিনের মতো আজও ওরা ৩ বন্ধু করুনাময়ীতে দেখা করেছে। একটু পরে চিন্টুও এসে পড়বে। চিন্টু মানে ত্বনির হবু বর। ওদের এই বন্ধু গ্রূপে চিন্টুও এখন অন্যতম। শান্তনু একটু মিচকে হেসে বললো, "আরে ওর অফিসের সেই তামিল সুন্দরী ওকে পাত্তাই দিলো না আজ।" রাগের মাথায় কৌস্তুভ হাতের সিগারেট ফেলে শান্তনুকে বললো, "এই শোন একদম বাজে বকবি না। আমার ওকে লাইন মারতে বয়েই গেছে। তুই আগে নিজেরটা বলনা। সেই যে তোর কাজলনয়না হরিণী।" তিন বন্ধুর হাসির ভিড়ে ওদের জগুদা স্পেশাল চিকেন উইংস এককোনে পরে রইলো।

কে বলে বন্ধুত্ব শুধু ছেলেবেলার হলেই পোক্ত হয়? ওরা জানে আজ যেমন সুখ টুকু ভাগ করে নিচ্ছে ওরা, প্রয়োজনে একে অন্যের পাশে শক্ত হয়ে দাঁড়াবে। সেই ভরসা আছে একজন আরেকজনের ওপরে। অথচ ওদের বন্ধুত্ব অনেক বড়বেলার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে জীবনের প্ৰথম চাকরি সূত্রে ওদের প্রথম আলাপ। কিন্তু সেসব আজ নেহাত অর্থহীন। ত্বনির কাছে ওরা কোনো ছোটবেলার বন্ধুর থেকে কম নয়। হয়তো বেশিই।

~তানিয়া

-

জবর খবর- ২

বাদর বন্ধুদের হাসিতে তন্বী আবার রেগে বোম হলো। তখন কৌস্তভ বললো, "শোন না। সিরিয়াসলি বলছি সুখবরই একটা আছে বটে। আমার এত ভালো একটা সুখবরের দিনে তুই মুখ হাড়ি করে থাকবি?" চিন্টু উত্তর দিলো, "এত ভনিতা না করে বলেই ফেলোনা ভাই। কি খবর?"

একটু ইতস্তত করে কৌস্তভ বললো, "এই মুহূর্তে আমার জীবনে কি সুখবর হতে পার অনুমান করো দেখি দাদাভাই।" তন্বী উৎসাহের চোটে ওকে কথা শেষ করতে দিলোনা। বলে উঠলো, "সেই মেয়েটা হ্যা বলেছে বুঝি?"

কে সেই মেয়ে? কি বৃত্তান্ত? জানাবো পরের পর্বে।

(চলবে)

-